ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
বিদেশ যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার অসুস্থতার কথা অস্বীকার করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হননি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের বৈঠকে আলোচনা করে বক্তব্য দেবেন তারা। ওই বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও থাকবেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি সিনহার ছুটির খবর সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়ার পর তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছিল। অসুস্থতার কারণে প্রধান বিচারপতি দীর্ঘ ছুটিতে গেছেন বলে আইনমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হলেও গত শুক্রবার বিদেশ যাওয়ার আগে বিচারপতি সিনহা সাংবাদিকদের বলেন, অসুস্থতা নয়, সরকারের আচরণে বিব্রত হয়ে তিনি ছুটি নিয়েছেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, তিনি ছুটি চেয়েছেন, ওটাও লিখিত বিষয়। আর সাংবাদিকদের কাছে বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে যেটি দিয়েছেন, এটাও লিখিত বিষয়। এ দুটি লিখিত বিষয় নিয়ে আমাদের দলের কার্যনির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভা হবে আজ সন্ধ্যায়। সেখানে আলাপ–আলোচনা করে আমাদের দলের বক্তব্য দেব। অসুস্থতার কথা অস্বীকারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, তিনি তো অসুস্থ বলে ছুটি চেয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে। দুটো চিঠি নিয়েই আমাদের আলাপ–আলোচনা করতে হবে। যিনি (আইনমন্ত্রী) জোর গলায় বলেছেন, অসুস্থতার (প্রধান বিচারপতি) কারণে ছুটি চেয়েছেন। তাকেও আমাদের আজকের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলে আসছে, প্রধান বিচারপতিকে ‘জোর করে ছুটি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে’। তবে চাপের বিষয়টি নাকচ করে বিচারপতি সিনহা বলেন, বিচার বিভাগ যাতে ‘কলুষিত না হয়’, সেজন্য তিনি নিজেই ‘সাময়িকভাবে’ বিদেশে যাচ্ছেন। তবে সরকার বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করে গেছেন বিচারপতি সিনহা। অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে গত শুক্রবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গারপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রাত ১০টায় রাজধানীর হেয়ার রোডের বাসভবন থেকে বের হয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী সুষমা সিনহা। সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব ও অতিরিক্ত জেলা জজ মো. আনিসুর রহমান জানিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি ও তাঁর স্ত্রী অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন। সেখানে মেয়ে সূচনা সিনহার বাড়িতে উঠবেন তাঁরা। সরকারি বাসভবন থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আর একপর্যায়ে কাগজে লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে দেন। সেখানে শুরুতেই বলা আছে, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।’ ওই বিবৃতিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। সাংবাদিকদের দেওয়া বিবৃতিটি লেখা ছিল প্রধান বিচারপতির প্যাডে। নিচে ছিল প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর। বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল (গত শুক্রবার) প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’ গত ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে অবস্থানের জন্য অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকার কথা উল্লেখ করেন। এর আগে গত ২ অক্টোবর এক মাসের ছুটির আবেদন করেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ছুটির কারণ হিসেবে তিনি ‘অসুস্থতা’র কথা উল্লেখ করেন। সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ এক মাস অবকাশ শেষে কোর্ট খোলার পর প্রথম দিন থেকেই তিনি ছুটিতে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা দায়িত্ব পালন করবেন।’ এ ছাড়া গত ১০–২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে ছুটিতে ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। প্রসঙ্গত, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশের পর থেকে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি। জাতীয় সংসদেও তাঁর সমালোচনা করা হয়।